ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের স্মরণকালের ভয়াবহ পতন ঘটলেও বিন্দুমাত্র অনুশোচনাবোধ নেই দলটির। উল্টো একের পর এক ইস্যু তৈরি করে দেশকে কিভাবে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়া যায় এবং ঠুনকো বিষয়কে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ইস্যু বানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কিত করা যায়- তারই ছক কষছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে খোদ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নেন। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রায় সব পর্যায়ের নেতা-মন্ত্রী ও এমপিরা আত্মগোপনে রয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এখনো সক্রিয় রয়েছেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রকাশ্যে না এলেও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের অনেকেই ভেতরে ভেতরে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে বিদেশে গেলেও দেশের অভ্যন্তরে থাকা বাছাইকৃত কিছু নেতা-কর্মীর সাথে সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। ওই নির্দেশনার আলোকে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সাইবার যোদ্ধারা অনলাইন-অফলাইনে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। দুর্গা পূজা উপলক্ষে চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির ছয় সদস্য গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নগরের একটি পূজামণ্ডপের অনুষ্ঠান মঞ্চে দুটি গান পরিবেশন করেন। পূজা উদযাপন পরিষদের যুগ্মসম্পাদক সজল দত্তের আমন্ত্রণেই তারা গান পরিবেশন করলেও আওয়ামী লীগের সাইবার যোদ্ধারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রং চং লাগিয়ে তুলে ধরলে এটা নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। রীতিমতো ফেসবুকে একটি মল্লযুদ্ধ শুরু হয়। চাপের মুখে দুজনকে গ্রেফতারও করা হয়। তাতীবাজারসহ কয়েকটি পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ও পূজামণ্ডপে ইসলামী সংগীত পরিবেশনের বিষয়টি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূলে আঘাত হিসেবে দেখানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও আওয়ামী লীগ দেখাতে চায়- এ দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা ভালো নেই।
জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিত্যপণ্যের বাজারের চিত্র খারাপ অবস্থায় থাকলেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হিসেবে উল্লেখ করে দলটির সাইবার যোদ্ধাদের ফেসবুক ভেরিফাইড পেজে নিয়মিতই জোরালোভাবে প্রচারণা চলছে। দলটির সাইবার যোদ্ধারাও সেটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ হলেও দলটির নেতা-কর্মীরা তা এড়িয়ে যেতে চাইছেন। নিত্যপণ্যের বাজার চড়ার বিষয়টি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ইস্যু বানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলতে চায় এবং সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চায়।
গত ৫ আগস্টের পর গ্রাম পুলিশের আন্দোলন, আনসারদের আন্দোলন, পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষ, সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবীরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়মিত আন্দোলন করে যাচ্ছেন। এখনো দেশের বিভিন্ন গ্রাম-পাড়া মহল্লায় নানা ইস্যুতে সংঘাত সংঘর্ষ লেগে আছে। এসবের পছনে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা কলকাঠি নাড়ছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়াও ছাত্র-জনতার ওপর চিহ্নিত হামলাকারীদের ভিডিও ফুটেজ দেখে গ্রেফতার করা হলেও আওয়ামী লীগ ঢালাওভাবে গ্রেফতারের অভিযোগ তুলছে। গত ৫ আগস্টের পর ১৯ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন ছাত্রলীগ নেতা ও মাদক ব্যবসায়ী শামীম মোল্যা এবং চোর সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন তোফাজ্জল হোসেন। ওই দুটি ঘটনাকে ‘মব জাস্টিসের’ ধুয়া তুলে সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোর শিক্ষার্থীদের ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন ফজলুল হক মুসলিম হলের একাধিক ছাত্রলীগ নেতা।
পুলিশ ও আমলা প্রশাসনে এখনো চারটি স্তরে আওয়ামী লীগ আমলের নিয়োগকৃত কর্মকর্তারা রয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা আত্মগোপনে থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে তাদের দোসর ওই আমলা ও পুলিশ প্রশাসনে এখনো তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। দলটির নেতারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হত্যা, গণগ্রেফতার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ ইস্যুভিত্তিক বিভিন্ন ঘটনা জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারলে এর মাধ্যমে দেশে জনঅসেন্তাষ তৈরি হলে অন্তর্বর্তী সরকার প্রচণ্ড চাপের মুখে থাকবে। এর মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও সৃষ্টি হবে। তখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডসহ ইতিবাচক দিকগুলো উচ্চারিত হবে। এই সুযোগে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনায় অতীতে যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে তাতে আবারো আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসাতে পুনর্বিবেচনার জন্য দেশের মানুষই কথা বলা শুরু করবে।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, গত ৫ আগস্টের পর দেশে কয়েকটি ইস্যু তৈরি হয়েছে। যেগুলো রং চং লাগিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে একটি সেনসেশন তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। এসব করার মাধ্যমে দেশে একটি হই চই ফেলে দেয়ার চেষ্টা রয়েছে যাতে অন্তর্বর্তী সরকার চাপে থাকে, কোনো কাজ সরকার সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে যাতে করতে না পারে। তিনি আরো বলেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে যে দলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাদের দীর্ঘদিনের শাসনের পতন ঘটেছে মূলত তারাই প্রতিহিংসাবশত এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। তাদের উদ্দেশ্য জনঅসন্তোষ তৈরি করে সাধারণ জনগণকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা। এ দেশের কিছু লোকজন তো এখনো চায় আগের কর্তৃত্ববাদী রিজিম ফিরে আসুক।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, একের পর এক ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে মূলত অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য। সরকার যাতে সুষ্ঠুভাবে কোনো কাজ মনোযোগ দিয়ে করতে না পারে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে গেলেও তাদের প্রেতাত্মারা এখনো রয়ে গেছে। তাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। তিনি বলেন, তা ছাড়া দীর্ঘদিন শাসন করা আওয়ামী লীগের অধিকাংশই এখনো বিশ্বাস করে- তারা আবার যেকোনো সময় ক্ষমতায় চলে আসবে। এজন্য তারা নানা উসকানিতে পা রাখছে। কিন্তু এটা যে সম্ভব নয়, তারা এটাও বিশ্বাস করতে চায় না।